বর্ষা মৌসুমকে সামনে রেখে নেত্রকোনায় চলছে নৌকা তৈরির ধুম, ব্যস্ত সময় পার করছেন নৌকা কারিগররা, আসছে বর্ষাকাল। চলছে নৌকা তৈরি ও পুরোনো নৌকা মেরামতের ধুম। প্রতিবছর বর্ষা আসার আগেই হাওরাঞ্চল নেত্রকোনায় শুরু হয়েছে নৌকা তৈরির কাজ। এ সময়টাতে নৌকার কারিগরদের ব্যস্ততা বেড়ে যায় বর্ষাকালে এ জেলার অধিকাংশ জনপদ পানিতে থই থই করে। ডুবে যায় রাস্তাঘাট, নদী-নালা ও খাল-বিল। নৌকা দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। মৎস্যজীবীরাও মাছ ধরার কাজে ব্যবহার করেন ছোট বড় নৌকা।
তাই বর্ষা মৌসুম আসলেই এ অঞ্চলে বেড়ে যায় নৌকার কদর। সংশ্লিষ্টরা জানান, জেলার খালিয়াজুরী,মোহনগঞ্জ,মদন, বারহাট্টা, কেন্দুয়া, কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, পূর্বধলা, আটপাড়া সহ প্রায় ১০০-২৫০ জন কাঠমিস্ত্রি রয়েছে। এ সকল কাঠমিস্ত্রিরা বর্ষা মৌসুম শুরুর মাসখানেক আগে থেকেই নৌকা তৈরির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বছরের বাকি সময়টা তাঁরা চেয়ার-টেবিল, দরজা-জানালাসহ অন্যান্য আসবাবপত্র তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
নৌকার কারিগর কাঠমিস্ত্রি মহাদেব সূত্রধর জানান, কাঠের কাজ তাঁর পেশা। বর্ষাকাল শুরুর ১-২ মাস আগে থেকেই তিনি নৌকা তৈরির কাজ শুরু করেন। বর্ষায় নৌকা আর বছরের বাকি সময়টা চেয়ার-টেবিল, দরজা-জানালা তৈরি করে চলে তার সংসার।
খালিয়াজুরী এলাকার প্রবীণ কাঠমিস্ত্রি বিশনো সূত্রধর জানান, নয় হাত লম্বা একটি নৌকা ৩ / ৪ হাজার টাকা এবং ১২ হাত নৌকা ৫ / ৬ হাজার টাকায় বিক্রি করছেন। কারখানা ছাড়া হাটবাজারে তিনি নৌকা বিক্রি করেন না।
এ ছাড়াও খালিয়াজুরী সহ আশপাশের বিভিন্ন উপজেলা থেকে মানুষ এসে তার কাছ থেকে নৌকা তৈরি করে নিয়ে যায়। শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন নয়, মুসলমানদের অনেকেই এখন এ পেশার সঙ্গে জড়িত। এ মৌসুমে নৌকা তৈরির কাজ বেশি পান। গত কয়েক দিনে তিনি বেশ কয়েকটি নৌকা বিক্রি করেছেন।
লেপসিয়া গ্রামের নৌকা ক্রেতা বাবলু জানান, তিনি সাড়ে ৯ হাত লম্বা একটি নৌকা সাড়ে ৫ হাজার টাকায় কিনেছেন। বর্ষা মাসে তিনি কচুরিপানা কাটার কাজে নৌকা ব্যবহার করেন।
এখন গ্রামের পাশে গেলেই শোনা যাবে ঠুকঠাক শব্দ। একটি দু’টি নয়। ঘরে-ঘরে এ শব্দ। শব্দ যেনো মাধুরি মিশিয়ে যায়। জেলার সকল এলাকাজুড়ে হাতুড়ি-কাঠের শৈল্পিক ছন্দে যে কারো মন ভরে যাবে। প্রতিটি গ্রামজুড়ে বর্ষা আসার প্রায় এক মাস আগে থেকেই শুরু হয় নৌকা তৈরির ধুম। গ্রাম গুলোর পাশেই ধনু নদী ঘেঁষা শনিবারের হাটে জমে নৌকা বিক্রির হাট। এছাড়া লেপসিয়া ঐতিহ্যবাহী হাটে বসে নৌকা বিক্রির হাট।
কাকতালীয়ভাবে হলেও এ হাটও বসে প্রতি শনিবার। বর্ষা ঘনিয়ে আসলেই হাটটিতে রমরমা নৌকা বিক্রি হয়। বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাত্র পাঁচ মাসের মৌসুমি ব্যবসা। চাহিদা যথেষ্ট, তাই কারিগরদের ব্যস্ততাও বেশি। লেপসিয়া গেলে চায়ের দোকানে বসে নৌকা তৈরি গ্রামের কথা লোক মুখে শোনা যায়। সে সূত্র ধরেই স্থানীয় একজনের সহযোগীতা নিয়ে নৌকার গ্রামে যাত্রা। সহযোগী বলরামপুর গ্রামের আবুল হোসেন প্রথমে নিয়ে গেলেন লেপসিয়া গ্রামে। একে একে নৌকার গ্রাম লেপসিয়া ও পরে নৌকার হাট শনিবারের হাটে যাওয়া হয়। এই গ্রাম ছাড়া নেত্রকোনায় প্রতিটা গ্রামেও নৌকা তৈরি করা হয় বলে আবুল হোসেন জানান।
সরেজমিনে সেখানে গিয়ে দেখা গেলো, এলাকার অতশীপর বৃদ্ধ নারায়ণ চন্দ্র (সবাই ডাকে নারায়ণ বাবু) কাঠে হাতুড়ি মারছেন। তার ছেলে মলিন চন্দ্র কাঠ চাঁচছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো, এই এলাকার কারিগরেরা স্বাধীনতারও আগে থেকে নৌকা তৈরি করে আসছে। কারো-কারো মতে,এ এলাকার নৌকা তৈরির ইতিহাস প্রায় শতাব্দী প্রাচীন। লেপসিয়া এলাকার অতশীপরবৃদ্ধ অঞ্জনকুমার দাস বলেন, আমার জন্মের আগে থেইক্যা বাপ-দাদারা গয়না (নৌকা) বানাইয়া আইতাছে হুনছি। কারিগররা জানান, নৌকা তৈরির গ্রাম লেপসিয়া বললেই সবাই চেনে। তবে এ গ্রামটির ৯০ ভাগই মানুষ হিন্দু সম্প্রদায়ের।
হিন্দুরাই দীর্ঘদিন ধরে নৌকা তৈরি করে আসছে। আশির দশকের পর নৌকা ব্যবসায়ী কমে যায়। অনেকে ভারত চলে যাওয়ায় এখনো শতাধিক পরিবার টিকে রয়েছে কোনোমতে।
কারিগরেরা বলেন, নৌকা তৈরির কারিগরদের অবস্থা এখন কিছুটা ভাটা পড়েছে। ৯০’দশকের পর যান্ত্রিক সভ্যতা ফিরে আসায় নৌকার কদর কিছুটা কমে যায়। প্রতিবছর বর্ষায় নৌকা তৈরির ধুম চলে। তবে বন্যা হলে ব্যবসা ভালো হয় বলে জানালেন সুনীল দাস। তিনি বলেন, ৮৮’ আর ৯৮’ সালের বন্যায় অনেক টেহা লাব অইছিলো। তেঁতুলিয়া এলাকার নৌকার কারিগর রবি দাস বলেন, কাডের দাম বাইড়া যাওনে লাভটা কম হয়। নাইলে ব্যবসা খারাপ না। আর ষ্টেলের নৌকার কারনে কিছুডা লছ অইতাছে। তারপরেও খারাপ নাই। ডাইল-ভাত খাইবার পারি।কয়েকজন কারিগর তাপস দাসসহ কয়েকজন বলেন, এক-একটি নৌকা তৈরি করতে খরচ পড়ে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা।
আবার লাখ টাকায়ও নৌকা বানানো হয়। কোষা নৌকা বানাতে খরচ পড়ে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। নৌকার কারিগর হরিপদ সরকার ও সুবল চন্দ্র সরকার বলেন, প্রতি শনিবার লেপসিয়া হাটে নৌকা বিক্রির হাট জমে। এখানে শত শত নৌকা বিক্রি হয়। তারা বলেন, দাদু পানি আইলে ব্যবসা ভালাই অয়। তহন নৌকা কেনার ধুম পড়ে। জেলার এই এলাকা থেকে নৌকা কিনতে এসেছেন রজব আলী। কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, বর্ষাকাল আসলে লেপসিয়া এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। তখন নৌকার প্রয়োজন পড়ে। এখানে ভালো দামে নৌকা পাওয়া যায়।
Leave a Reply