নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় একদিনে অতি বৃষ্টির কারণে প্লাবিত হয়েছে উপজেলার নিম্নাঞ্চল। সহাস্রাধিক পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সবজি বাগানে, তলিয়ে গেছে অসংখ্য আমনের খেত। আশ্রয়ন প্রকল্পের খেটে খাওয়া মানুষদেরও ঘরে পানি ঢুকে যাওয়ায় তারা পাশ্ববর্তী প্রাইমারি স্কুলে আশ্রয় নিয়েছে।
সরেজমিনে কথা হয়, উপজেলার মোজাফরপুর ইউনিয়নে জালিয়ার হাওরের পশ্চিম পাড়ে রাজি নদীর কোল ঘেঁষে গড়ে উঠা বড়তলা আশ্রয়ন প্রকল্প- ১ ও ২ – এ অবস্থানরত সোনা মিয়ার সাথে।
সে জানায়, শেখের বেটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমরার লাইগ্যা ঘর দিছে। আমরা সুন্দর ঘর পাইয়া মহাসুখে দিন পার করতাছি কিন্তু অতিরিক্ত বৃষ্টি কিংবা বর্ষকাল এলে আমাদের ঘরের ভিতর অনায়াসে পানি ঢুকে পড়ে। সেই সময় আমাগোর এই সুন্দর ঘর ছেড়ে পাশ্ববর্তী বড়তলা ও মহুরিয়া প্রাইমারি স্কুলে গিয়া আশ্রয় লই।
ভূমি ও গৃহহীন মানুষদের বাসস্থান এ আশ্রয়ন প্রকল্পটি । দরিদ্র মানুষের দুঃখ দূর্দশা লাগবের কথা চিন্তা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশ্রয়ন প্রকল্পটি নির্মাণ করলে অতি বৃষ্টি ও বর্ষাকাল আসলে তাদের দুঃখ দূর্দশা কাটছে না। এসময় আশ্রয়ণের ঘরে উঠে পানি, ছাড়তে হয় তাদের সাজানো ঘর বাড়ি। এই কষ্ট সহ্য করেও বেশ কিছু পরিবার টিকে থাকার চেষ্টা করছে।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের আরেক বাসিন্দা লিটন মিয়া জানান, অতিরিক্ত বৃষ্টি কিংবা বর্ষকালের কথা মনে অইলে আমরার মনে আতঙ্ক দেহা দেয়। আমরার সাজানো ঘর বাড়ির খাট,চৌকি,ডেক-ডেকসি,খেতা- বালিশ ও গরু-ছাগল লইয়া নৌকা দিয়া বড়তলা ও মহুরিয়া প্রাইমারি স্কুলে আশ্রয় লই। ঘর গুলি যদি আরো ২/৩ ফুট উচা কইরা ভিট বানাইলে আমরার কপালে এত দুঃখ দূর্দশা অইতো না।
এব্যাপারে উপজেলার মোজাফরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো.জাকির আলম ভূঞা বলেন, এই প্রকল্পের কাজটি আমার সময়ে হয়নি। তবে প্রকল্পটি নির্মাণ করার সময় পরিকল্পনায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরের ভিটা যদি আরো ২/৪ ফুট উঁচু করে করতেন তাহলে এখন আর এসমস্যা হত না। আশ্রয়ণ প্রকল্পের অবস্থানরত মানুষের দুঃখ দূর্দশা লাগব করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে ঘরের ভিটা উঁচু করার জন্য প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করছি। অপরদিকে অতি বৃষ্টি কারণে উপজেলার সর্বত্র জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে বাদ যায়নি কেন্দুয়া পৌরশহর।
জলাবদ্ধতায় পৌরশহরের কান্দিউড়া, শান্তিবাগ, আরামবাগ ও কমলপুরের বিভিন্ন এলাকায় তলিয়ে গেছে। পানি উঠেছে বাসাবাড়ি ও দোকানে। বাসায় পানি ওঠায় অনেকের রাত কেটেছে নির্ঘুম। আসবাবপত্র ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ভিজে বাসিন্দাদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সীমাহীন ক্ষতি হয়েছে ঢাকা স্ট্যান্ডার্ড বেকারির। বেকারিতে পানি ওঠায় চিনি, আটা, ময়দাসহ বিভিন্ন মালামাল ভিজে একাকার হয়েছে।
এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত অনেকের বাসাবাড়িতে পানি রয়েছে। রাস্তাঘাট ও গাছপালারও ক্ষতি হয়েছে।স্থানীয় সংসদ সদস্য অসীম কুমার উকিল এলাকার সার্বিক খোঁজখবর রাখছেন বলে জানান কেন্দুয়া উপজেলা আওয়ামী যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো তাজুল ইসলাম।
এলাকার পরিস্থিতি স্বচক্ষে দেখতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) কাবেরী জালাল বিভিন্ন এলাকায় পরিদর্শন করেছেন।
উপজেলা চিরাং ইউনিয়নের মৎসচাষি আব্দুর রউফ জানান, সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখেন তার পুকুর পাড়ে প্রায় হাঁটু পানি। তিনি শিং ও মাগুর মাছ চাষ করেছিলেন। তার অন্তত ১০/১২ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেন।
উপজেলার শ্রেষ্ঠ মৎসচাষি মো. আবু হারেছ জানান, ৪টি পুকুরের পাড় ভেঙে ও ডুবে সব মাছ বেরিয়ে গেছে। অর্ধ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।
পিজাহাতি গ্রামের শাহজাহান বাঙ্গালি বলেন: তার ১৭ কাঠা (১৭০ শতক) জমি পানির নিচে। এসব জমিতে ৪৯ ও হাইব্রিড জাতের ধান করছিলেন। সবেমাত্র তোড় এসেছে দুই-চার দিন পরে এই জমি ভাসলেও ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। রউফ, ঝুমন, হারেছ নয়; এমন হাজারো মৎসচাষি পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে বিষাদের আবহ বইছে। একই অবস্থা বিরাজ করছে হাজার হাজার কৃষক পরিবারে।
উপজেলা কৃষি অফিসার শারমিন সুলতানা জানান, প্রাথমিক অবস্থায় ৩ হাজার ৫০০ হেক্টর ধানের জমি নিমজ্জিত হয়েছে। তবে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। পানি যদি দুয়েকদিনের মধ্যে না কমে তাহলে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বেন কৃষকরা।
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য অফিসার আজহারুল আলম জানান, এখন পর্যন্ত যেটুকু খবর নিতে পারছি তাতে হাজারের অধিক পুকুর ডুবে যাওয়ার খবর পেয়েছি। তবে এর সংখ্যা আরও বাড়বে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার কাবেরী জালাল জানান, টানা বর্ষণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে অনেক পুকুর, আমন ফসলের জমি, সবজি খেত ডুবে গেছে। কয়েকটি স্থানে রাস্তা ধসে গেছে। দুপুর থেকে বৃষ্টি কমেছে। আর বৃষ্টি না হলে এবং দুয়েক দিনের মধ্যে পানি সরে গেলে ধানের খুব বেশি একটা ক্ষতি হবে না।
তবে মৎসচাষিদের যে ক্ষতি হয়েছে তা পোষানো কঠিন।অপরদিকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাজ তখন কীভাবে করা হয়েছে তাতো আমি জানি না। তবে প্রকল্পের অবস্থানকারীদের কথা শুনেছি।
অতিরিক্ত বৃষ্টি কিংবা বর্ষকাল এলেই ঘরের ভিটা পানির নিচে তলিয়ে যায়। এই ঘরের ভিটা উঁচু করতে একটি আলাদা প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় বরাদ্দ পেলেই সংস্কার করা সম্ভব।
Leave a Reply